বাংলাদেশ কি অসুস্থ রাষ্ট্র?

সামাজিক ও রাজনৈতিক রোগতত্ত্ববিদ্যার আলোকে বাংলাদেশও একটি অসুস্থ রাষ্ট্র। আদুল আদুল চর্বিযুক্ত শরীর—যাকে ‘উন্নয়ন’ বলা হচ্ছে, তার নিচে অসংখ্য দগদগে ঘা, আর কিলবিল করা রোগজীবাণু। রুগ্‌ণ; রোগপ্রতিরোধ-ক্ষমতা নেই। 

বাংলাদেশের রাষ্ট্রিয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে যখন পুরোপুরি রোগগ্রস্ত করে তোলা হয়েছে, তখন আরও রোগ বাঁধানোর পক্ষে যেকোনো যুক্তিই কুযুক্তি। রোগ নিরাময়ের যুক্তিই সুযুক্তি। সমাজচিন্তকদের দায়িত্ব হোক রোগের পক্ষে জিকির-কীর্তন বন্ধ করা এবং একটি একটি করে রোগ ধরিয়ে দিয়ে সারানোর ও চিকিৎসার সুপরামর্শ দেওয়া। এ সত্যটি বলা যে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোকে সুস্থ-সবল রেখে তাদের নিজ নিজ দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে দেওয়ার নামই গণতন্ত্র।

কানাডা প্রসঙ্গ টানলে অনেকেই বলেন, বাংলাদেশ কানাডা নয়; কোথায় আগরতলা কোথায় জারুলতলা ইত্যাদি। এই আত্মপ্রতারণামূলক আত্মপ্রবোধ অর্থহীন। উদাহরণ কানাডার হলেও মূল প্রসঙ্গ মোটেই কানাডা নয়; বরং প্রতিষ্ঠান ও প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ যে সংসদীয় গণতন্ত্রের অত্যাবশ্যকীয় শর্ত, সেই বৈশ্বিক সত্যের ইঙ্গিত দেওয়া। ধনী কিংবা দরিদ্র, উন্নত বা অনুন্নত যেকোনো দেশই হোক না কেন—সৎ, স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক ও দায়িত্বশীল রাষ্ট্রচরিত্র সবখানে একই। মানবদেহের মতো। সাদা-কালো, লম্বা-বেঁটে হলেও সব মানুষের রক্তের রং, রক্তসঞ্চালন, হৃৎপিণ্ড, স্নায়ুতন্ত্র, পরিপাকতন্ত্র যেমন একই রকম, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর বা রাষ্ট্রের মূল অঙ্গগুলোর কাজও সব দেশে একই রকম।

‘সামাজিক রোগতত্ত্ববিদ্যা’ এবং ‘রাজনৈতিক রোগতত্ত্ববিদ্যা’র নানা গবেষণার মূল প্রতিপাদ্য—যেসব দেশে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো সৎ, স্বচ্ছ, দায়িত্বশীল, দুর্নীতিমুক্ত, জবাবদিহিমূলক এবং সুশাসনযুক্ত—সেই সব দেশে নাগরিকের আয়ু বেশি, শারীরিক–মানসিক সুস্থতা অতুলনীয়, রোগ-বালাই কম, রোগপ্রতিরোধশক্তি বেশি ইত্যাদি। এই তালিকা দীর্ঘ। 

শারীরিক সুস্থতার কারণ মানসিক সুস্থতা। মানসিক সুস্থতার কারণ নাগরিকের সুনিদ্রা ও কম টেনশন। সুনিদ্রা ও টেনশনমুক্তির কারণ রাষ্ট্রের মূল চারটি প্রতিষ্ঠান—আইন, শাসন, বিচার ও নিরাপত্তার সততা, স্বচ্ছতা, দায়িত্বশীলতা, দুর্নীতিমুক্ততা, জবাবদিহিমূলকতা এবং সুশাসন। ন্যায্যতা নিশ্চিত, সুবিচার ও সুশাসন নিশ্চিত—তাই নাগরিক সুনিদ্রা দেয়, টেনশনমুক্ত থাকে। মানবিক, পরোপকারী ও সংবেদনশীল হয়। দেশগুলোর জনগণ সুখী, বসবাসযোগ্য ও শান্তিবাদী থাকে। কারণ তারা জানে ‘আমরা সবাই রাজা’ বা ‘আমরাই ক্ষমতাধর’। তাদের আত্মবিশ্বাস, সাহস, মনোবল, মতপ্রকাশের ও সত্য কথা বলার সৎসাহস তৈরি হয়। অগণতান্ত্রিক দেশের হিসাব সম্পূর্ণ বিপরীত। জনগণ তো বটেই, দেশগুলোই একধরনের ভয়াবহ শারীরিক-মানসিক অসুস্থতার আবর্তে ঘুরপাক খেতে থাকে।