লিডারশীপ কি? কিভাবে চর্চা করতে হয়?

লিডারশীপ জন্মগত নাকি গ্রো করা যায়? 

গবেষণা অনুসারে, লিডারশীপ স্কিল আমরা শুধুমাত্র জন্মগতভাবে পাই না— সময়ের সাথে সাথে আমরা অনেক নেতৃত্ব দক্ষতা শিখি এবং অর্জন করি। যদিও পরিবার, সমাজ থেকেই কিছু স্কিল জন্মগতভাবে কেউ কেউ পেয়ে যায়, তবে বেশিরভাগ স্কিল আপনাকে শিখতে হয়। সেজন্য একজন প্রকৃত লিডার হতে হলে আপনাকে নিয়মানুসারে শিখতে হবে এবং নেতৃত্ব গুণাবলী অর্জন করতে হবে।

লিডারশীপ

ভালো লিডার হওয়া সময়-সাপেক্ষ ব্যাপার। আপনি হয়তো একটি কোম্পানীর কোন ডিপার্টমেন্টে গত ১০-১৫ বছর ধরে লিড দিচ্ছেন, তবুও একজন প্রকৃত লিডার হতে, যুগের সাথে চলতে হলে, আপনাকে প্রতিনিয়ত শিখতে হয়, চর্চা করতে হয়।

সুতরাং যদি প্রশ্ন করেন সফল ব্যক্তিদের কি কি লিডারশীপ গুণাবলী থাকা উচিত— সেটা এক কথায় উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়। যদিও অনেক বিশ্ব লিডারদের জীবনী পড়ে এবং কিছু অসাধারণ লিডারদের সাথে ব্যক্তিগতভাবে মিশে কিছু স্পেশাল গুণ দেখেছি। যেসব দক্ষতাগুলো যেকোন লিডারের ভেতর না থাকলে তার নেতৃত্ব গুণ নিয়ে প্রশ্ন উঠে। চলুন সে ধরণের ৭ টি লিডারশীপ গুণাবলী নিয়ে আলোচনা করি।


১. ভিশনারী (স্বপ্নদর্শী)

প্রথমত একজন লিডারকে অবশ্যই ভিশনারী হতে হবে। একজন সফল লিডার জানেন কীভাবে ক্লিয়ার এবং এচিভেবল ভিশন তৈরি করতে হয়। একটি ব্যবসার অভারঅল প্লান এবং গোলের সাথে সামঞ্জস্য রেখে কীভাবে ভিশন তৈরি করে তা টিমের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হয় তা তিনি জানেন। টিমের মধ্যে অনিশ্চয়তা অবশিষ্ট না রেখে কীভাবে কাজে ফোকাস থাকতে হয় তা তিনি ভালো জানেন। আর একজন ভিশনারী লিডারকে দেখে পুরো টিম উৎসাহিত হন। টিমের মধ্যে একজন লিডার তার ভিশন ছড়িয়ে দেওয়ার সঠিক মাধ্যমেই গুড লিডার থেকে গ্রেট লিডার হয়ে উঠতে পারেন। তার তৈরি ভিশন থেকে তিনি ফোকাস হারান না এবং তা থেকেই পুরো টিমের মধ্যে সর্বদা উত্তেজনা বিরাজ করে। টিমের প্রতিটি কর্মী কোম্পানীর ভিশনকে সফল করতে তখন আপ্রাণ চেষ্টা করে।


২. কৌশলগত চিন্তা:

একজন গ্রেট লিডার কোথা থেকে শুরু করে কোথায় যেতে চান তার একটি ক্লিয়ার প্লান তাঁর থাকে। টিমের মধ্যে যেকোন সমস্যা তৈরি হলে তা তিনি সঠিকভাবে হ্যান্ডেল করতে পারেন এবং টিমের মধ্য থেকেই সমাধান বের করার ব্যবস্থা করেন। চাপের মধ্যেও তিনি কীভাবে স্থির থাকতে হয় এবং কোয়ালিটি ডিসিশন নিতে হয় তা তিনি জানেন। আত্মবিশ্বাস ধরে কীভাবে টিমমেটদের সাথে কাজ শেয়ার করতে হয় তার উদাহরণ সৃষ্টি করেন। একটি ভালো ব্যবসা রাইট প্লানিং ছাড়া বেশি দূরে যেতে পারে না। আর একজন প্রকৃত লিডার কোম্পানীর রিসোর্সকে সামনে রেখে স্ট্রাটেজিক প্লান এবং রিয়েলেস্টিক গোল সেট করেন যা টিমের মধ্যে অনুপ্রেরণা এবং শৃঙ্খলা নিয়ে আসে। কোম্পানীর কর্মীদের সন্তুষ্ট রেখে তিনি ম্যানেজমেন্টকে আশার আলো দেখাতে পারেন।


৩. সহমর্মিতা:

একজন সফল নেতা জানেন যে কাজের সাথে সাথে মানুষও গুরুত্বপূর্ণ। আর এজন্য মানবিক হওয়াটাও প্রয়োজন। সেজন্য একজন গ্রেট লিডার অন্য কর্মীদের প্রতি সর্বদা সহানুভূতিশীল। তারা যেমন টিমের অন্যদের কথা শুনেন তেমনি নতুন যেকোন কিছু শিখতেও প্রস্তুত থাকেন। তিনি টিম মেম্বারদের কথা শুনে তাদের অনুভূতি, চাহিদা বুঝতে চান এবং পাশের মানুষের প্রতি সত্যিকার আগ্রহ দেখান। মানুষ তার পাশের জনের দ্বারা প্রভাবিত। সুতরাং একজন লিডার হিসাবে আপনি যখন সহানুভূতিশীল হন, তখন টিমের সকলেই সকলের প্রতি সহানুভূতিশীল আচরণ করে। এজন্য একজন কার্যকর নেতা তাদের টিমের প্রতি মনোযোগ দেন, তাদের কাজকে সফল করতে তাদের সাথে গুরুত্বের সাথে ব্যবহার করেন।


৪. উদ্যমী

সেরা নেতার গুণাবলীর মধ্যে উদ্যমী হওয়া একটি উল্লেখযোগ্য গুণ। একজন গুড লিডার তার টিমের প্রজেক্টকে কর্মপ্রেরণা এবং উদ্দীপনার সাথে এগিয়ে নিয়ে যান। আপনি নিজে যদি উৎসাহী বা কর্মশক্তিপূর্ণ না হন তবে আপনার টিমও ঝিমিয়ে পড়বে। মনে রাখবেন আবেগ সংক্রামক এবং আপনি যদি কর্ম উদ্দীপনা দিতে না পারেন তাহলে আপনার টিমও কাজের প্রতি অনিহা প্রকাশ করবে। তাই যারা আপনার সাথে কাজ করছে তাদের সাথে আপনার আনন্দ-উৎসব ভাগাভাগি করুন। এমনভাবে কাজ করুন যেন তারা আপনাকে অনুসরণ করতে চায়—অর্থাৎ তাদের কাছে রোল মডেল হোন, অধ্যবসায়ী হোন এবং ইতিবাচকতার সাথে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করুন। এমন একজন উদ্যমী লিডারকে সবাই ভালোবাসেন। সেই সাথে ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স নিয়ে জানতে পারবেন এই কোর্সে।


৫. সমন্নয়কারী বা কলাবোরেটর

একজন সত্যিকার লিডার একজন ভালো কমিউনিকটরও বটে। তিনি জটিল কনসেপ্ট খুব সহজে বোঝাতে পারেন, আবার বুঝতেও পারেন। তিনি এমনভাবে যোগাযোগ করেন যেন অন্যরা তার দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সম্পৃক্ত হতে পারে। তিনি সহজ-সরলভাবে নিজেকে উপস্থাপন করতে পারেন। তিনি কখনই আক্রমনাত্মক নন এবং দৃঢ়তার সাথে টিমের সাথে মিলেমিশে চ্যালেঞ্জকে মোকাবেলা করতে পারেন। একজন গ্রেট লিডার কথা বলার চেয়ে শোনেন বেশি এবং কোন কথাকে গুরুত্বের সাথে নিতে হবে তাও তিনি দক্ষতার সাথে হ্যান্ডেল করতে পারেন। তারা যেমন আশপাশের খোঁজ-খবর রাখেন তেমনি পরিস্থিতি খুব যত্ন সহকারে নিজের কন্ট্রোলে নিতে পারেন। সুতরাং একজন গ্রেট লিডার হতে হলে আপনার চারপাশে কি ঘটছে তা জানতে হবে এবং টিমের সবার সাথে যত্ন সহকারে নিজেকে প্রকাশ করতে হবে।


৬. লিডার তৈরি করা

একইভাবে একজন লিডার শুধুমাত্র নিজেকে তৈরি করেন না, তিনি টিমের মধ্যে আরও লিডার তৈরিতে সময় দেন। প্রতিটি প্রজেক্ট তিনি ছোট ছোট ভাগ করে অন্যদের বুঝিয়ে দেন এবং সেখানে তিনি কর্মোদ্দম অনুসারে নতুন লিডার বেছে নেন। ছোট ছোট টিম করে কীভাবে বড় কাজকে তুলে আনতে হয় তা তিনি ভালো জানেন। অন্যদিকে টিমের কার ভেতর কি সম্ভাবনা বেশি তাও তিনি গুরুত্বের সাথে দেখেন এবং সে অনুসারে তিনি পরবর্তীতে কাজ ‍বুঝিয়ে দেন। টিম যতো বেশি ছোট করে কাজ ডিভাইড করা যায় ততই তা আরও বেশি কার্যকরী হয়। দিন দিন টিম বড় করে বড় বড় প্রজেক্ট আরও সহজে সম্পন্ন করা সহজ হয়ে যায়। প্রতিটি টিম মেম্বারকে কীভাবে উৎসাহ দেওয়া যায় এবং তার ভেতর থেকে কীভাবে আরও বেশি সফলতা বের করা নিয়ে আসা যায় তা একজন গুড লিডার অনুধাবন করেন। এজন্য একজন গ্রেট লিডার প্রতিনিয়ত নতুন লিডার তৈরিতে দক্ষতার সাথে কাজ করে থাকেন।


৭. ন্যায়পরায়ণতা

সবশেষে একজন লিডারকে অবশ্যই ন্যায়পরায়ণ এবং সৎ হতে হবে। সততা যেকোন লিডারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। যদি একজন লিডার উপরের অন্য সকল গুণাবলী থাকে তবু তিনি অসৎ হন তাহলে তিনি টিমের উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারেন না। একজন অসৎ লিডারের সাথে অন্য টিম মেম্বাররা কাজ করতে ভালোবাসেন না। তার নির্দেশনা অন্যদের কাছে ফেক মনে হয়। সুতরাং একজন লিডারকে অবশ্যই বিশ্বস্ত হতে হবে—টিমের অন্যরা যেন তার উপর ভরসা করতে পারে। সবাইকে যেমন তিনি সমানভাবে আচরণ করবেন ঠিক তেমনি তিনি সবাইকে সমান সম্মান করবেন। তিনি যেমন নিজের ভুল অন্যের উপর চাপিয়ে দিবেন না তেমনি যে যেটার প্রাপ্য তাকে সেটা দিবেন। অর্থাৎ একজন লিডারের দৃষ্টিভঙ্গি যত বেশি সৎ এবং স্বচ্ছ হবে, যাদের নেতৃত্ব দেবেন তাদের সম্মান, আস্থা এবং আনুগত্যের সাথে নেতৃত্ব দিবেন তিনি তত বেশি পুরস্কৃত হবেন।


কোন কাজগুলো একজন লিডারের এড়িয়ে চলা উচিত?

একটি কাজ বা প্রজেক্ট শেষ করার নির্দিষ্ট কোন ফর্মুলা নেই, তবে কিছু কিছু প্রাকটিস আছে যা আপনি এভোয়েড করলে আপনার গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পাবে।

  • যিনি মনে করেন তিনি সব জানেন বা বোঝেন এবং অন্য কেউ তার থেকে এ বিষয়ে বেশি জানতে পারে না— এমন কারও সাথে কাজ করা আসলেই কষ্টকর। একজন টিম লিডারের এমন গুণ থাকা ভয়ঙ্কর— বিজনেস, টিম মেম্বার, সর্বোপরি সবকিছুর জন্য।
  • যোগাযোগের গুরুত্ব না বোঝা— অর্থাৎ একজন লিডার টিমকে সঠিক তথ্য, গাইড দিতে পারে না, অনুপ্রাণিত করতে পারে না।
  • অন্যদের কথা না শুনা, না বুঝতে চাওয়া।
  • সঠিক সময়ে উপকারী উত্তর বা কাজ দিতে না পারা একজন লিডারের ব্যর্থতা।
  • মিথ্যা কথা বলা, প্রতারণার আশ্রয় নেওয়া একজন লিডারের খুব বাজে গুণাবলীর মধ্যে অন্যতম।
  • প্রতিটি কাজ বা ব্যক্তির মধ্যে শতভাগ নিখুঁত হোয়া খোঁজা।
  • কর্মীদেরকে মেশিন ভাবা, অর্থাৎ মানবিক আচরণ ভুলে যাওয়া।
  • ত্যাগের মন-মানসিকতা না থাকলে।
  • স্বার্থ বা অসততার উদ্দেশ্যে কার্যক্রম চালানো।
  • প্রচুর ইগো থাকা, হঠাৎ রেগে যাওয়া।
  • ট্যালেন্ট তৈরিতে ব্যর্থ হওয়া।
  • কর্মীদের প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে পাশে না থাকা একজন লিডারের সফল না হওয়ার বড় কারণ।

সুতরাং উপরের বিষয়গুলো একজন লিডারকে অবশ্যই এড়িয়ে চলতে হবে, মেনে চলতে হবে। সেই সাথে উক্ত গুণাবলী প্রতিনিয়ত প্রাকটিস করতে হবে।


শেষ কথা

আশা করি একজন সফল লিডার বা নেতার কি বিশেষ গুণাবলী থাকে তা উপলব্ধি করেছেন। এখন আপনাকে একজন প্রকৃত লিডার হতে উপরের গুণগুলো বেশি বেশি প্রাকটিস করতে হবে। আপনার টিমের ভেতরে এই গুণাবলী ছড়িয়ে দিতে হবে। তাহলে আপনার টিম হবে একটিভ এবং অন্যের জন্য অনুকরণীয়।