উদ্ভাবনী মানসিকতার চর্চার অভাব

মানুষের চিন্তাগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তার পারিপার্শ্বিক-কেন্দ্রিক হয়, এ জন্যই সংস্কৃতির ভিন্নতার কারণে মানুষে মানুষে দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। যেমন আমরা আমাদের জীবনকে যেভাবে দেখি বা পরিচালিত করতে চাই, ভিন্ন সংস্কৃতির লোকজন তাদের পারিপার্শ্বিক অবস্থার সাপেক্ষে জীবন নিয়ে ভাবে এবং সে মোতাবেক পরিচালনা করতে চায়। আমাদের দৃষ্টিকোণ থেকে যা সঠিক বলে মনে করি, তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে কখনো তা ভুল। আমরা যা পাপ বলে মনে করি, তারা কখনো তা ভাবে জীবনের প্রয়োজন। তাই আমাদের ভুলগুলো হয় পারিপার্শ্বিক অবস্থার সাপেক্ষে। যেমন আমাদের সমাজব্যবস্থায় ভালো রেজাল্ট, ভালো চাকরি সাফল্যের মাপকাঠি হিসেবে ধরা হয় আপাতদৃষ্টে, তাহলে বাকি মানুষগুলো কি অসফল? আমি মনে করি, মানবজাতিকে কিছু দেওয়ার ক্ষমতা যে রাখে, সে-ই সফল। একজন মানুষের চিন্তার উৎকর্ষ ও মানবিকতা তাকে সমৃদ্ধ করে। মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি নির্ভর করে, সে কোন সমাজব্যবস্থায় আছে।  জীবনে যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে তার নেতিবাচক দিকগুলোও ভাবুন। অর্থাৎ আপনি যেমন করে ভবিষ্যৎ কল্পনা করছেন, তা তেমন না হলে আপনি মেনে নিতে কতটা প্রস্তুত বা বিকল্প কোনো পথ আছে কি না? মানুষের চাওয়ার মতো করে যদি তার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত বা ফলাফল না হয়, তখন সে মনে করে তার সিদ্ধান্তে ভুল ছিল, কখনো এর জন্য সে আফসোস করে। মানুষের যেকোনো সাফল্য শুধু তার একক প্রচেষ্টা বা ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে না, এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেকের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ, এদের মধ্যে কেউ যদি সঠিক ভূমিকায় না থাকে, আপনার কি করার আছে? কাজেই আপনার ব্যর্থতার জন্য অন্যরাও দায়ী থাকে। কাউকে বিশ্বাস করলে সে আপনার বিশ্বাসের মর্যাদা নাও রাখতে পারে। কেউ আপনার মতো চলতে বা কাজ করতে বাধ্য নয়। মানুষ জানে না তার চলার পথে কোন কোন বাধাবিপত্তি অপেক্ষা করছে এবং তা জয় করতে কতটা সক্ষম? তাই মানুষের পরিকল্পনা কখনো কখনো বাস্তবায়িত হয় না। মানুষের নিজেরও কিছু দূরদর্শিতা থাকতে হবে। আবেগের চেয়ে বিবেক দিয়ে চলা জরুরি। আবেগ মানেই সেখানে অনুভূতির তীব্রতা বেশি, সময়ের সঙ্গে অনুভূতিগুলো রং বদলায়, কাজেই বাস্তবতার নিরিখে সিদ্ধান্ত নেওয়া যুক্তিযুক্ত। জীবনে বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হয়, তা না হলে মানুষ গতিশীল কী করে হবে? জীবনের কোন সিদ্ধান্ত ভুল আর কোনটা সঠিক, তা সময় সবচেয়ে ভালো জানে। যেকোনো কাজে একনিষ্ঠতা ও সততা থাকা জরুরি। কাজে ভুল নিয়ে আফসোস নয়, বরং তা থেকে শিক্ষা নিয়ে আবার নতুন কোনো সিদ্ধান্ত নিন।
অস্থির এই সময়ে একটি সুসংবাদে সচেতন নাগরিকমাত্রই আশান্বিত হবেন। গত ১৭ মে সেই সংবাদটি প্রকাশিত হয়েছে, শিরোনাম 'শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ক্লাব গঠন বাধ্যতামূলক হচ্ছে'। ওই সংবাদ থেকেই জানা গেছে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বিজ্ঞান চর্চা, বিতর্ক প্রতিযোগিতা ও সংস্কৃতি চর্চার লক্ষ্যে ক্লাব গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর শিগগিরই এই কার্যক্রম চালুর নির্দেশনা দেবে। 'শিখন-শেখানো' কার্যক্রমের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের মূল্যবোধ তৈরিসহ দক্ষ ও যোগ্য করে গড়ে তুলতেই এই উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে বলে জানানো হয়েছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে থাকবে বিজ্ঞান ক্লাব, নাটকের ক্লাব, সাহিত্য ক্লাব, সংগীত চর্চার ক্লাব, ডিবেট ক্লাবসহ ডজনখানেক ক্লাব। এ খবর নিঃসন্দেহে আনন্দের এবং আশাজাগানিয়াও বটে।

আমাদের তরুণ প্রজন্ম তথা শিক্ষার্থীরা শিক্ষাঙ্গনে পাঠ্যবই এবং নোট-গাইড মুখস্থ করে প্রচলিত পরীক্ষা পদ্ধতির মধ্য দিয়ে যে শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে, তা যে পরিপূর্ণ শিক্ষা নয় এবং প্রকৃত শিক্ষিত মানস গঠনের জন্য সহায়ক নয়, তা সচেতন নাগরিকমাত্রেরই জানা। এ রকম বাস্তবতায় সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্লাব গঠন বাধ্যতামূলক করার যে পদক্ষেপ নিতে চলেছে, তা আরও অনেক আগেই নেয়া উচিত ছিল। সমাজের শিক্ষাবিদ, সংস্কৃতিকর্মী এবং চিন্তাশীল সচেতন মানুষ বহুদিন ধরেই আমাদের শিক্ষাঙ্গনে তরুণ-তরুণীদের প্রকৃত সুনাগরিক হয়ে গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার অপূর্ণতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছিলেন।

এমন উদ্বেগের যৌক্তিক কারণও ছিল। শিক্ষার্থীদের প্রকৃত মেধার বিকাশ এবং ইতিবাচক মূল্যবোধ সৃষ্টির জন্য প্রয়োজন ছিল তাদের মধ্যে শৈশব থেকেই সৃজনশীলতা, উদ্ভাবনী ক্ষমতা, মানবিক মূল্যবোধ এবং দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের ক্ষেত্রে সচেতনভাবে তাদের গড়ে তোলা। সেই ইতিবাচক শিক্ষায় শিক্ষার্থীকে সুনাগরিক তথা সৃষ্টিশীল দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে পরিবার এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভূমিকা সমান গুরুত্বপূর্ণ। মুখস্থ বিদ্যানির্ভর পরীক্ষা পদ্ধতির শিক্ষার সীমাবদ্ধ গণ্ডি থেকে তরুণ প্রজন্মকে বের করে আনার ক্ষেত্রে পরিবার এবং শিক্ষাঙ্গনে সংস্কৃতিচর্চার কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে আমরা এই সহজ সত্য উপলব্ধি এবং তা বাস্তবায়নে যুগের পর যুগ কালক্ষেপণ করে এসেছি।

বিলম্বে হলেও মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর সেই উদ্যোগ নিতে চলেছে। এ উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে আমাদের তরুণ প্রজন্ম যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে এক নতুন যুগে প্রবেশ করবে- এমন আশা করাই যেতে পারে। অধিদপ্তরের এই সিদ্ধান্ত ঘোষণার আগে শিক্ষামন্ত্রী ডাক্তার দীপু মনি এ ধরনের ক্লাব গঠনের নির্দেশনা দিয়েছিলেন। ক্লাব গঠন করে বিজ্ঞান, সাহিত্য, সংগীত, বিতর্কসহ শিক্ষাঙ্গনে সংস্কৃতিচর্চা অব্যাহত রাখার পরামর্শ দিয়েছিলেন। শিক্ষামন্ত্রী জানিয়েছিলেন, নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীদের সহশিক্ষা কার্যক্রমের সুযোগ থাকবে। পাশাপাশি ক্লাব গঠন ও চর্চা অব্যাহত রেখে শিক্ষার্থীদের মেধা ও মননের বিকাশ ঘটানো হবে।

পর্যাপ্ত অর্থ এবং সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা থাকলে সারা দেশে সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বিপুল ভূমিকা রাখতে পারে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, গণগ্রন্থাগার, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র, বাংলা একাডেমিসহ সৃজনশীল প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিষ্ঠান। দেশে মনোজাগতিক সাংস্কৃতিক উন্নয়ন ঘটাতে হলে ব্যাপক কার্যক্রম গ্রহণ করা দরকার। বাংলাদেশের সেই সক্ষমতা আছে। প্রয়োজন শুধু যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ এবং তা বাস্তবায়নে অগ্রণী ভূমিকা নিয়ে এগিয়ে আসা।

এ ক্ষেত্রে সত্যিকারের জ্ঞানভিত্তিক সংস্কৃতিমান একটি সমাজ গড়তে হলে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জন্য অন্তত দশ গুণ বাড়ানো উচিত বর্তমান বরাদ্দ। সারা দেশে হাজার হাজার পাঠাগার। এসব পাঠাগারে তরুণ প্রজন্মকে নিয়ে আসতে হলে আকর্ষণীয় কর্মসূচি এবং উৎসবের পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। বইয়ের সরবরাহ বাড়াতে হবে কমপক্ষে দশ গুণ। মফস্বলের বহু পাঠাগার আছে, যেগুলো প্রয়োজনীয় বই আর পাঠকের অভাবে নীরবে-নিভৃতে ধুঁকছ।

এই লেখার শুরুতেই উল্লেখ করেছি অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশের অভাবনীয় অগ্রগতির কথা। ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়িত হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী এখন স্মার্ট বাংলাদেশ বাস্তবায়নের স্বপ্ন ছড়িয়ে দিয়েছেন দেশবাসীর মনে। ২০৪১ সাল নাগাদ উন্নত বিশ্বের কাতারে সমৃদ্ধ দেশগুলোর অন্যতম হবে বাংলাদেশ। সে লক্ষ্যে টেকসই উন্নয়ন মাথায় রেখেই কাজ করছে সরকার। কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে যতই অগ্রগতি হোক, চেতনাগত এবং মানবিক, সাংস্কৃতিক মূল্যবোধগত দিক থেকে উন্নয়ন ঘটানো না গেলে আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থান্ধ বিপুল জনসংখ্যার এই দেশকে টেকসই উন্নয়নের পথে নিয়ে যাওয়া অসম্ভব। কারণ উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে থাকা চাই সুস্থ মনোবৃত্তির মানুষ। একটি ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ, অপরাধপ্রবণ জনগোষ্ঠী দিয়ে টেকসই উন্নয়ন ধরে রাখা অসম্ভব। বঙ্গবন্ধু যে কারণে সোনার বাংলা গড়ার জন্য সোনার মানুষ কামনা করেছিলেন।

সুতরাং একটি জ্ঞানভিত্তিক ও সংস্কৃতিমান জাতি হিসেবে বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে হলে শিক্ষা, বিজ্ঞান, সাহিত্য, সংস্কৃতি ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিপুল কর্মপ্রণোদনা সৃষ্টি ছাড়া বেশি দূর এগোনোর সম্ভাবনা কম। এমনকি মৌলবাদ রুখতে হলেও প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক চেতনায় নবীন প্রজন্মকে গড়ে তুলতেই হবে। আশা করি শিক্ষাঙ্গনে পরিবর্তন আনার স্বপ্ন দেখার পাশাপাশি সারা দেশে মানুষের মনোজাগতিক উন্নয়নের জন্য বাজেট প্রণয়নেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখবে।